ইলম বাদ দিয়ে পার্থিব শিক্ষা জায়িয নয়! -শাইখুল হাদীস মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.
::
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَعْدَ اللهِ ؕ لَا یُخْلِفُ اللهُ وَعْدَهٗ وَلٰکِنَّ اَكْثَرَ النَّاسِ لَا یَعْلَمُوْنَ ﴿۶﴾ یَعْلَمُوْنَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَیٰوۃِ الدُّنْیَا ۚۖ وَهُمْ عَنِ الْاٰخِرَۃِ هُمْ غٰفِلُوْنَ ﴿۷﴾
“আল্লাহ্ তা’আলা তার ওয়াদা খেলাফ করেন না, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। তারা শুধু পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিকটা জানে এবং তারা পরকালের খবর রাখে না।” (সূরাহ রুম, ৬-৭)
উক্ত আয়াতের সারবস্তু হলো- পরকাল থেকে গাফেল হয়ে দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করা বুদ্ধিমত্তা নয়, বরং চরম নির্বুদ্ধিতা। বর্ণিত আয়াতে যারা শুধু দুনিয়াদার ও ইংরেজদের শিক্ষায় শিক্ষিত, যারা দীন ধর্ম সম্পর্কে কোন ইলম রাখেনা, দীনের ইলমের কোন পরওয়াও করে না- এমন লোকদের ব্যাপারে এ কথা বলা হয়েছে যে, পার্থিব জীবনের একটা সাইড তাদের নখদর্পনে কেবল। ব্যবসা কিরূপে করবে, কিসের ব্যবসা করবে, বীজ কখন বপন করবে, শষ্য কখন কাটবে, দালান-কোঠা, বিল্ডিং কিভাবে নির্মাণ করবে, বিলাস-বাসনের উপকরণ কিভাবে আহরণ করবে- এ বিষয়ে তারা সম্যক অবগত, কিন্তু এই পার্থিব জীবনেরই অপর মূল ও প্রধান পিঠ তথা দীন সম্পর্কে তথাকথিত বড় বড় পণ্ডিতরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
অথচ এ পিঠের উদ্দেশ্য হচ্ছে, পার্থিব জীবনের স্বরূপ ও তার আসল লক্ষ্যকে ফুটিয়ে তোলা; অর্থাৎ এক কথায় প্রকাশ করা যায় যে, দুনিয়া একটা মুসাফিরখানা। এখান থেকে আজ না হয় কাল যেতেই হবে। মানুষ প্রকৃতপক্ষে এখানের বাসিন্দা নয়, বরং পরকালের বাসিন্দা, এখানে কিছু দিনের জন্য আল্লাহ্র ইচ্ছায় আগমন করেছে মাত্র। এখানে তার কাজ এই যে, স্বদেশে বেহেশ্তে সুখে কালাতিপাত করার জন্য এখান থেকে সুখের সামগ্রী সংগ্রহ করে সেখানে প্রেরণ করবে।
বলা বাহুল্য, এই সামগ্রী হচ্ছে ঈমান ও নেক আমল। কুরআন পাকে বিশ্বের খ্যাতনামা ধনৈশ্বর্যশীল ও ভোগ-বিলাসী জাতি সমূহের কাহিনীতে পরিপূর্ণ। তাদের অশুভ পরিণতি দুনিয়াতে সবার সামনে স্পষ্ট। আর পরকালের চিরস্থায়ী আযাব তো তাদের ভাগ্য লিপিতে বন্টিত হয়েছে। তাই এসব জাতিকে কেউ বুদ্ধিমান ও দার্শনিক বলতে পারে না। চরম পরিতাপের বিষয়, আজকাল যে ব্যক্তি অধিকতর অর্থ জমা করতে পারে এবং ভোগ বিলাসের উৎকৃষ্টতর সামগ্রী জোগাড় করতে সক্ষম হয়, তাকেই সর্বাধিক বুদ্ধিমান বলা হয়- যদিও সে দীন-ধর্ম সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ।
শরী’আতের দৃষ্টিতে এরূপ লোককে বুদ্ধিমান বলা বুদ্ধির অবমাননা ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ্ তা’আলা ও তার রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দৃষ্টিতে একমাত্র বুদ্ধিমান তারাই, যারা আল্লাহ্ তা’আলা, নবী-রাসূল, পরকাল এবং জান্নাত-জাহান্নামের ব্যাপারে ঈমান রাখে; এবং তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে, আর দুনিয়ার চীজ ও আসবাবকে প্রয়োজন পর্যন্ত সীমিত রাখে; এগুলোকে কখনো জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বানায় না। উল্লেখিত বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, যারা দীনী ইলম থেকে বঞ্চিত- যারা কোন দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ইলম হাসিল করেনি বা খানকায় গিয়ে কিংবা দাওয়াতের লাইনে যেয়ে অথবা অন্য কোনভাবে হক্কানী উলামা ও বুজুর্গগণের সাথে সম্পর্ক রেখে সহীহ ইলম হাসিল করেনি, তারা জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান নয়। যদিও তারা তাদের ন্যায় দুনিয়াদার ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে বড় বড় সনদ প্রাপ্ত হোক না কেন বা যদিও তাদেরকে মূর্খ লোকেরা মহাজ্ঞানী, বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবী মনে করুক না কেন। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, ৬-৭২২)
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
وَکَذٰلِکَ جَعَلْنَا فِیْ كُلِّ قَرْیَۃٍ اَکٰبِرَ مُجَرِمِیْهَا لِیَمْكُرُوْا فِیْهَا ؕ وَمَا یَمْكُرُوْنَ اِلَّا بِاَنْفُسِهِمْ وَمَا یَشْعُرُوْنَ ﴿۱۲۳﴾ (الانعام: ١٢٣)
“যে ব্যক্তি ছিল মৃত, তাকে আমি জীবিত করেছি এবং তাকে এমন একটি আলো দিয়েছি, যা নিয়ে সে মানুষের- মধ্যে চলাফেরা করে। সে ব্যক্তি কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে, যে অন্ধকারে রয়েছে, সেখান থেকে বের হতে পারছে না?” (সূরাহ আনআম, ১২৩)
উল্লেখিত আয়াতে ঈমান-ইসলাম, ইলম-আমলকে নূর বা আলো বলা হয়েছে, আর কুফর-শিরক ও মূর্খতা-বদদ্বীনীকে জুলমাত বা অন্ধকার বলা হয়েছে। এ দৃষ্টান্তটি পুরোপুরি বাস্তব সম্মত। কারণ- আলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিকট ও দূরের বস্তুসমূহ দেখা। যার ফলে ক্ষতিকর বস্তুসমূহ থেকে বেঁচে থাকা যায় এবং উপকারী বস্তুসমূহ হাসিল করার সুযোগ পাওয়া যায়। ঈমান ও দীনী ইলম এমন একটি নূর, যার আলো সমগ্র জমীন, আসমান ও এতদুভয়ের বাইরের সব বস্তুতে প্রতিফলিত হয়। একমাত্র এ আলোই দুনিয়া ও আখিরাতের সব কিছুর বিশুদ্ধ ফলাফল দেখাতে পারে। যার কাছে এ নূর থাকে, সে-ই ইহকাল ও পরকালের ক্ষতিকর বস্তুসমূহ থেকে বেঁচে থাকতে পারে, উপকারী বস্তুসমূহ হাসিল করতে পারে এবং উভয় ব্যাপারে অপরকেও পথ প্রদর্শন করে সাহায্য করেতে পারে।
পক্ষান্তরে যার কাছে ঈমান ও ইলমের আলো নেই। দুনিয়ার লাইনে সে ব্যক্তি যতবড় ডিগ্রীধারী হোক না কেন, সে নিজে অন্ধকারে নিমজ্জিত। তার প্রতিপালকের দৃষ্টিতে ইহকাল ও পরকালের উপকারী ও ক্ষতিকর বস্তুসমূহ থেকে সে অজ্ঞ। সুতরাং সে নিজে উপকারী ও অপকারী বস্তুসমূহ বাছাই করতে পারে না এবং অপরকেও এ ব্যাপারে কোনরূপ সহযোগিতা করতে পারে না। শুধু হাতের কাছের বস্তুসমূহ আলো না থাকায় অনুমান করে কিছুটা চিনতে পারে। ইহকালীন জীবনই হচ্ছে হাতের কাছের বস্তু। তাই কাফির ও ইলমবিহীন মানুষেরা এ ক্ষণস্থায়ী জীবন এবং এর লাভ-লোকসান কিছুটা চিনে নেয়। এমন একজন ইলমবিহীন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চোখটাকে কিভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, এর মধ্যে কতগুলো অংশ আছে, এর মধ্যে কি কি রোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে এবং তার চিকিৎসা কি এসব ব্যাপারে কিছু ধারণা রাখলেও সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে এ চক্ষু কেন দিয়েছেন? এ চক্ষুকে কিভাবে ব্যবহার করলে একজন মানুষ বেহেশতী হতে পারে এবং কিভাবে ব্যবহার করলে সে নিশ্চিত জাহান্নামী হবে, এ ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। এ ব্যাপারে সে ব্যক্তি একেবারেই অজ্ঞ। মোদ্দাকথা, ইলমবিহীন মানুষেরা আলোর অভাবে ইহকালের বিষয়সমূহকে ধারণা ও অনুমান করে কিছুটা বুঝতে সক্ষম হলেও, পরকালীন জীবনের কোন খবরই রাখে না এবং সে জীবনের লাভ-লোকসানের কোন অনুভূতিও তার নেই।
উল্লেখিত আয়াতে বলা হয়েছে-মুমিন ঈমানের আলো নিয়ে মানুষের মধ্যে চলাফেরা করে। এ দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যে, ঈমান ও কুরআনের ইলমের নুর মসজিদ, মাদ্রাসা বা খানকাহ হুজুরার মধ্যে সীমাবদ্ধ-থাকে না। যে ব্যাক্তি আল্লাহ্র পক্ষ হতে এ নূর প্রাপ্ত হয়, সে এ নূর নিয়ে নতুন সমাবেশে চলাফেরা করে এবং সর্বত্র এ দ্বারা নিজেও উপকৃত হয় এবং অপরকেও উপকার পৌঁছায়। আলো কখনো অন্ধকারের কাছে পরাভূত হয় না। একটি মিটিমিটি প্রদীপও অন্ধকারের নিকট নতি স্বীকার করে না। তবে প্রদীপের আলো অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে না। কিন্তু আলোর কিরণ প্রখর হলে, অনেক দূর পর্যন্ত সে আলো পৌঁছে যায়। অবশ্য আলো সর্বাবস্থায়ই অন্ধকারকে ভেদ করে, অন্ধকার তাকে পরাভূত করতে পারে না। অন্ধকার যে আলোকে পরাভূত করে সেটি আলোই নয়। তেমনিভাবে মুমিন ব্যক্তি কাফিরের নিকট নতি স্বীকার করতেই পারে না। যদি করে, তাহলে সে আর মুমিন উপাধি পাওয়ার যোগ্য নয়।
উল্লেখিত বর্ণনার দ্বারা বুঝা গেল- মুমিন ও ইলমওয়ালা তার নুর দ্বারা নিজেও উপকৃত হয় এবং তার ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তার নূর দ্বারা অন্য লোকেরাও উপকৃত হতে থাকে। যেমন, আলোর মালিক যদিও নিজের জরুরতে আলো নিয়ে বের হয়, অন্যের উপকার সাধন তার উদ্দেশ্য থাকে না এবং অন্য ব্যক্তিরাও তার আলো থেকে উপকৃত হওয়ার ইরাদা নিয়ে বের হয় না, তথাপিও তার আলো দ্বারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় স্বাভাবিকভাবে সবাই কিছু না কিছু উপকার লাভ করে। পক্ষান্তরে ইলমবিহীন কাফির নিজেও যথাযথ উপকৃত হতে পারে না, আর তার দ্বারা অন্যদের প্রকৃত উপকার ও কল্যাণের তো কোন সম্ভাবনাই নেই।
বর্ণিত আয়াতের সার কথা হলো, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে-দুনিয়া ও আখিরাত সামনে রেখে কুরআনের আলোকে সকল আমলের পরিণাম চিন্তা করা এবং এটা নির্ধারণ করা যে, সাময়িক দিক দিয়ে কোন বস্তু উপকারী এবং কোন বস্তু ক্ষতিকর। অতঃপর উপকারী বস্তুসমূহ অর্জন করা এবং ক্ষতিকর বস্তু সমূহ থেকে বেঁচে থাকা। অপরকেও এসব উপকারী বস্তুসমূহের প্রতি আহবান করা এবং ক্ষতিকর বস্তুসমূহ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হওয়া। যাতে করে চিরস্থায়ী সুখ, আরাম ও শান্তির জীবন অর্জিত হয়।
যখন মানব জীবনের উদ্দেশ্য ও মানবিক পূর্ণতার এ আদর্শগত উপকার নিজেকে অর্জন করতে হবে এবং অপরকে পৌঁছাতে হবে, তখন কুরআনের এ দৃষ্টান্ত অতি উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠে যে ঐ ব্যক্তিই জীবিত, যে আল্লাহ্ ও তার রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং ইলমে দীন অর্জন করে। আর আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ সমূহ তাঁর রাসূলের তরীকা মুতাবিক পালন করে। পক্ষান্তরে ঐ ব্যক্তি মৃত, যে ঈমান-ইসলাম, ইলম-আমল থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছে এবং দুনিয়াকে লক্ষ্য বস্তু বানিয়ে তার জন্য নিজের মূল্যবান যিন্দেগীকে মাটি করেছে।
স্মর্তব্য যে, নিছক মানবিক জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিজ্ঞান সায়েন্সের রিসার্চ দ্বারা কোন মানুষকে জীবিত হওয়ার সনদ প্রদান করা যায় না। তার নিকট সৃষ্টিকর্তার পরিচয়, তার নিজের পরিচয়, তার জীবনে লক্ষ্য, তার পরিণাম ও পরবর্তী জীবনের স্বরূপ সম্পর্কে ইলম না থাকায় সে ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে যিন্দা হলেও কুরআনের পরিভাষায় সে মৃত। সে না নিজের উপকার করতে পারে, না অন্যের উপকার করতে পারে। বর্ণিত আয়াতে কাফির ও মুমিনের পার্থক্য বর্ণনা করা হয়েছে, মুমিন ও কাফিরের অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়েছে। তিক্ত হলেও সত্য যে, বর্তমান দীন বিমুখ ইংরেজদের পার্থিব শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানদের অবস্থা আয়াতে বর্ণিত কাফিদের অবস্থার অনুরূপ। তাদের নিকট কুরআনের ইলমের আলো না থাকায় তারা জায়িয-নাজায়িয, ভালো-মন্দ পার্থক্য করতে অক্ষম এবং নিজের ও অন্যের সঠিক কল্যাণ সাধনেও অক্ষম। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ৩/৪৩৬)
বই:- "সন্তানের শ্রেষ্ঠ উপহার"
No comments