খাঁটি নিয়ত ও পরিশুদ্ধ আমল
অয়েজুল হক;
রাসুল (সা.) বলেছেন, 'আখলিছ দ্বিনাকা ইয়াকফিকাল আমালুল কালিলদ'। অর্থাৎ তোমার ইমানকে খাঁটি করো, অল্প আমলই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে। এই যে নাজাত, এটাই বান্দার জন্য চূড়ান্ত সফলতা। যে নাজাত পেল তার জীবন সার্থক। অধিকাংশ মুসলিম 'ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন' মৃত্যু দোয়া হিসেবে পড়ে থাকে। হ্যাঁ, এটা তো তিনিই শিখিয়ে দিয়েছেন। বান্দাকে বড় এক সান্ত্বনার বাণী আল্লাহতায়ালা বলে দিলেন, 'যারা তাদের ওপর কোনো মুসিবত আপতিত হলে বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। তাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে বিপুল অনুগ্রহ ও রহমত। আর এরাই সঠিক পথের পথিক' (সুরা বাকারা, ১৫৬, ১৫৭)।
পৃথিবীতে আসার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু এই ফিরে যাওয়া। পৃথিবীতে আমরা ছিলাম না; এসেছি আবার ফিরে যাব। মাঝখানের অনির্দিষ্ট, অজানা সময়টা হলো জীবন। কে জানে, কার সামনে অপেক্ষা করছে ফিরে যাওয়ার সময়! আচ্ছা, ঢাকার বাসিন্দা কেউ চট্টগ্রামের উদ্দেশে ভ্রমণ শুরু করলে তিনি কি বলবেন- চট্টগ্রাম ফিরে যাচ্ছি? না, এটা বলবেন না। বললেও ভুল কথা বলা হবে। তার বাড়ি ঢাকাতে আসার সময় তিনি বলবেন, বাড়ি ফিরে আসছি। ফিরে আসা, ফিরে যাওয়া দ্বারা মূলত তার স্থায়ী গন্তব্য বা ঠিকানা বোঝায়। মহান আল্লাহ এ জন্যই যে কোনো মসিবতে স্মরণ করিয়ে দিলেন তার আসল ঠিকানার কথা। কেউ মরে গেছে, ফিরে গেছে শুনে আমি নিজেকেই স্মরণ করিয়ে দিই- আমাকেও কিন্তু ফিরে যেতে হবে। এমনটাও দেখা যায়, কেউ হয়তো গোনাহ করেছে, মরে গেছে। আরেকজন বলছে, লোকটা বাজে। তার জন্য আমি ইন্না লিলল্গাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়ব না। এটা অনেকক্ষেত্রে অহঙ্কার। নিজেকে বড় ভালো মনে করা। তিনি জানেনই না এর দ্বারা মৃত ব্যক্তির মাগফিরাত কামনা করা হচ্ছে না বরং তিনি নিজেই স্মরণ করছেন, তারও কিন্তু ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ যেন বলেন, বড় বিপদগ্রস্ত, অসুস্থ, অভুক্ত? চিন্তা করো না, তুমি না আমার। সামান্য সময়। তুমি তো অচিরেই আমার দিকে (তোমার আসল ঠিকানা জান্নাতে) ফিরে আসবে। আর সেখানে রবের অনুগ্রহ ও রহমতে সিক্ত হবে। সেখানে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, চিন্তা নেই। শুধু শান্তি আছে। সুখ আছে। কেমন সুখ? এমন সুখ, যে সুখের বর্ণনা দূরে থাক, সর্বোচ্চ চিন্তা দিয়ে তা কল্পনাও করতে পারবে না কোনো মানুষ, কোনো জ্ঞানী।
কে জান্নাতে যাবে? যার ইমান আছে সে যাবে। নবীজি বললেন, তোমার ইমান খাঁটি করো। ইমান যদি খাঁটি হয় অল্প আমলেও নাজাত পেয়ে বান্দা আলল্গাহর জান্নাতে প্রবেশ করবে। ইমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু মৌলিক বিষয় রয়েছে। তার শাখা-প্রশাখা আছে। যিনি ইমানের শাখা-প্রশাখাগুলোকে যত বেশি দৃঢ়ভাবে অন্তরে ধারণ করেন, তিনি তত বেশি খাঁটি ইমানদার। খাঁটি ইমানদার অল্প আমলেই নাজাত পাবেন। আমল অল্প হোক; কিন্তু আমল কেমন হওয়া দরকার? এ সম্পর্কে আলল্গাহতায়ালা সুরা বাইয়েনাতের পাঁচ নম্বর আয়াতে বলেন, 'তাদের এ ছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আলল্গাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত দেবে। আর জেনে রাখো, এটাই সঠিক ধর্ম।' এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট, আমল বা ইবাদত যাই করা হোক, সেটা হতে হবে খাঁটি মনে, একনিষ্ঠভাবে। একনিষ্ঠভাবে করতে হবে প্রতিটি ইবাদত। একনিষ্ঠ ইবাদতের সঙ্গে অন্তরের বড় এক সম্পর্ক। নিয়তের সম্পর্ক অন্তর বা মনের সঙ্গে। নামাজ যেন এ জন্য না হয়, লোকে আমাকে নামাজি বলবে। জাকাতের উদ্দেশ্য যেন এটা না হয়, মানুষ বড় দানশীল বলবে। জাকাত যে দান নয় গরিবের হক, সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে জনপ্রিয়তার জন্য জাকাত দিচ্ছেন! ধনীর জন্য হজ ফরজ ইবাদত। একজন হজে যাচ্ছেন আর ভাবছেন (তার নিয়ত), বিমানে চড়ে নতুন জায়গায় ভালো ভ্রমণ হবে। ভালো কিছু
সস্তায় পেলে কিনে আনতে হবে। ফিরলেই মানুষ ডাকবে হাজি সাহেব বলে। সমাজের মানুষের কাছে তিনি বেশ সম্মান পাবেন।
কেউ হজে যাচ্ছেন, উদ্দেশ্য ব্যবসা। প্রতি বছর হজে যান বলে তার বিরাট সম্মান। হজে যান আরেক হাজি সাহেবের পকেট কাটতে। নিয়তে গরমিল।
হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি নবীকে (সা.) বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে, যার নিয়ত সে করবে। অতএব, যে ব্যক্তি আলল্গাহ ও তার রাসুলের উদ্দেশে হিজরত করবে, তার হিজরত আলল্গাহ ও তার রাসুলের জন্যই হবে। আর যে দুনিয়া লাভের জন্য কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে, তার হিজরত ওই বিষয়ের জন্যই হবে, যার জন্য সে হিজরত করেছিল (সহিহ বুখারি হাদিস ১; সহিহ মুসলিম হাদিস ১৯০৭)।
বোঝা গেল, নিয়তের ওপরই সব আমল বা কাজের প্রতিদান দেওয়া হবে। মানুষকে হয়তো রঙঢঙ দেখিয়ে মন ভোলানো যাবে; কিন্তু তাতে লাভ কী! মহান আল্লাহর কাছে আমাদের যাবতীয় আমল গৃহীত হওয়ার জন্য বাহ্যিক কোনো রঙঢঙ নয় বরং নিয়তের বিশুদ্ধতাই বিবেচ্য বিষয়। কে সুন্দর,
রূপবতী, ধনবান, ক্ষমতাশালী এগুলো আলল্গাহতায়ালার কাছে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, 'আলল্গাহ তোমাদের শরীর ও আকৃতির দিকে লক্ষ্য করেন না বরং তিনি তোমাদের অন্তর দেখেন' (বোখারি ও মুসলিম)।
আমি মুখে কী বলি, একই সঙ্গে অন্তরে কী লালন করি, আলল্গাহতায়ালা দুটিই একসঙ্গে দেখেন। ওপরের (বাহ্যিক) ইবাদতের সঙ্গে আন্তরিকতা না থাকলে সে ইবাদত আলল্গাহতায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা যতটুকু আমল করি, তা যেন পরিশুদ্ধ হয়। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।
ইসলামী গবেষক
hoque9203@gmail.com
No comments